এই ব্লগটি সন্ধান করুন


বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০০৯

প্রত্যাখান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না |
অমন সুধাকরুণ সুরে গেয়ো না |
সকালবেলা সকল কাজে আসিতে যেতে পথের মাঝে
আমারি এই আঙিনা দিয়ে যেয়ো না |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না |

মনের কথা রেখেছি মনে যতনে |
ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই রতনে |
তুচ্ছ অতি, কিছু সে নয়- দুচারি-ফোঁটা-অশ্রু-ময়
একটি শুধু শোণিতরাঙা বেদনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

কাহার আশে দুয়ারে কর হানিছ !
না জানি তুমি কী মোরে মনে মানিছ |
রয়েছি হেথা লুকাতে লাজ, নাহিকো মোর রানীর সাজ–
পরিয়া আছি জীর্ণচীর বাসনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

কী ধন তুমি এনেছ ভরি দু হাতে ?
অমন করি যেয়ো না ফেলি ধুলাতে |
এ ঋণ যদি শুধিতে চাই কী আছে হেন, কোথায় পাই-
জনমতরে বিকাতে হবে আপনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

ভেবেছি মনে, ঘরের কোণে রহিব |
গোপন দুখ আপন বুকে বহিব |
কিসের লাগি করিব আশা- বলিতে চাহি, নাহিকো ভাষা-
রয়েছে সাধ, না জানি তার সাধনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

যে সুর তুমি ভরেছ তব বাঁশিতে
উহার সাথে আমি কি পারি গাহিতে !
গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান উছলি উঠে সকল প্রাণ,
না মানে রোধ অতি অবোধ রোদনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

এসেছ তুমি গলায় মালা ধরিয়া,
নবীনবেশ শোভনভূষা পরিয়া |
হেথায় কোথা কনকথালা, কোথায় ফুল, কোথায় মালা-
বাসরসেবা করিবে কেবা রচনা !
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||

ভুলিয়া পথ এসেছ, সখা, এ ঘরে-
অন্ধকারে মালা-বদল কে করে !
সন্ধ্যা হতে কঠিন ভূ একাকী আমি রয়েছি শুয়ে,
নিবায়ে দীপ জীবননিশি-যাপনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না |

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত‐অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু‐অমৃত করে দান॥
আকুল রাধা‐রিঝ অতি জরজর,
ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর—
তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
মরণ, তু আও রে আও।

ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি,
কোর‐উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি
নীদ ভরব সব দেহ।

তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি ছোড়বি,
রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি,
হিয়‐হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন—
অতুলন তোঁহার লেহ।

গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িতচকিত অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু সভয়‐তবধ সব—
পন্থ বিজন অতি ঘোর।

একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে—
ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
পন্থ দেখায়ব মোর।

ভানু ভণে, ‘অয়ি, রাধা, ছিয়ে ছিয়ে
চঞ্চল চিত্ত তোহারি।
জীবনবল্লভ মরণ‐অধিক সো,
অব তুঁহুঁ দেখ বিচারি।’

সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা–
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা—
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥

যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥